তিরিশ লক্ষের অধিক মানুষের লাশ

Pakistan's colonial exploitation, Largest genocide since World War II, Reluctance for the trial of War Criminals, History of Movement and Struggle


পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সর্ববৃহৎ গনহত্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে অনীহা, আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস


১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয় – পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।

পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। একেবারে শুরু থেকেই পাকিস্তানে শাসনের নামে ষড়যন্ত্র শুরু হয়, আর এই ষড়যন্ত্রে মূল ভূমিকা পালন করে সামরিক বাহিনী। যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোন নেতা, যেমন মোহাম্মদ আলী বগুড়া অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোন না কোন অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করত। নানারকম টালবাহানা করে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেন এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েই চলে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমুখি হয় যখন ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসন হতে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, যা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা-প্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু’জন প্রধানমন্ত্রী। কি অদ্ভুদ !

ষড়যন্ত্র : ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা কোন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। যদিও ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বোনা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল এই সিদ্ধান্ত। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং শুধুমাত্র তাঁর মুখের কথায় সারা পূর্ব পাকিস্তান অচল হয়ে যায়। সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে কিন্তু বুলেটের ভয় দেখিয়ে বাঙ্গালিদের রাজপথ থেকে সরানো যায় না। ৫ দিন হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।

সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল তখন সামরিক বাহিনীতে চলতে থাকে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার পূর্বপ্রস্তুতি। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। এদিকে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করতে থাকে, অপরদিকে চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণ। ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ভিত্তিতে “সরকারি যাত্রী” পরিবহণ করতে। এই “সরকারি যাত্রী”দের প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সেনা। এমভি সোয়াত নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাকিস্তানী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। কিন্তু বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে।

গণহত্যা-র সূচনা ও স্বাধীনতা ঘোষনা : অপারেশন সার্চলাইট অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। ২৫ মার্চে এবং এর আগের সময়গুলোতে বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়, তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে, এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয় এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সম্ভব দূরে রাখা হয়। বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয় নয়তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বাঙালি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। বাঙালি সৈনিকদের অনেককে ছুটিতে পাঠানো হয়, অনেককে নিরস্ত্র করা হয়, তবে এমনভাবে কাজগুলো করা যাতে কারও মধ্যে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়। অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা, চমকে দেয়া, প্রবঞ্চনা, এবং দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোড় দেয়া হয়। নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। গণহত্যা শুরু হলে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবের পাড়া গ্রামে। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদ এর উপর। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করে। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

তিরিশ লক্ষের অধিক মানুষ হত্যা : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালানো হয়। ২৫শে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শুরু করা অপারেশন সার্চলাইট নামক ধ্বংসযজ্ঞ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত চলে এবং এ নয় মাসে বাংলাদেশি কিছু ঘাতক দোসরদের সহায়তায় তিরিশ লক্ষের অধিক মানুষ হত্যা করা হয়। যুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে, যারা সে সময় দেশত্যাগ না করলে হয়তো গণহত্যার শিকার হত। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বহুসংখ্যক বাঙ্গালি নারী সম্ভ্রম হারায়; যার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। বাংলাদেশে ধারণা করা হয় প্রায় ২,০০,০০০ নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত হয় এবং তাদের গর্ভে অনেক যুদ্ধ শিশু জন্ম নেয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে পাকিস্তান আর্মি বহুসংখ্যক মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পরিবারের মেয়ে।

হানাদার বাহিনী ও দালাল : রাজাকার বাহিনী হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। এটি অখন্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার পাকিস্তানপন্থী শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান “পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স-১৯৭১” জারি করে আধাসামরিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ই সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক অধ্যাদেশ বলে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্য রূপে স্বীকৃতি দেয়। রাজাকার বাহিনীর প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। পরবর্তীকালে টিক্কা খানের সরকার সারা প্রদেশে বাধ্যতামূলকভাবে অনেক চোর ডাকাত ও সমাজবিরোধীকে রাজাকার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে। পরে আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গঠিত হয়। বাংলাদেশের গণহত্যা, লুটপাট, সম্পদ লুন্ঠন সব কাজে তারা ছিল বিভিষীকা। স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে – যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী – ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানের পদলেহী বাংলাদেশী বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের দল ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়।

যুদ্ধক্ষেত্র : মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের যুদ্ধগুলো ছিল পরিকল্পনা-হীন ও অপ্রস্তুত। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পরিকল্পিত রূপ পেতে শুরু করে। ১১ জুলাই বাংলাদেশের সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। কর্ণেল এম এ জি ওসমানীকে কমান্ডার ইন চিফ এর দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা অফিসারদের মধ্য থেকে প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে কমান্ডার নির্বাচন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগ ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সীমান্ত এলাকায় এবং ভারতের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ লাভ করত। সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তিনটি ব্রিগেড (১১ ব্যাটালিয়ন) তৈরি করা হয়। এছাড়াও প্রায় ১,০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের ভেতরে নিয়মিত বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো হতো। আগস্ট মাস থেকে শুরু হয় পরিকল্পিত হামলা।

আগস্টের পরপরই বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে সামরিক স্থাপনা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। গেরিলা হামলায় পাকিস্তানের চৌকস সামরিক বাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধারা। এমনকি রাজধানী ঢাকায় গেরিলা যোদ্ধারা দুঃসাহসী সব অভিযান চালায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল শত্রু-মুক্ত হতে শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর নিয়মিত কাজ ছিল সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করা। সীমান্তে ও অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের জবাবে তারা এ অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তারা দিনের বেলাতেও নিজেদের সামরিক ঘাঁটি থেকে বের হতে ভয় পেত। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জরুরী ভিত্তিতে আরো সৈন্য তলব করা হয়।

ধীরে ধীরে পাকিস্তানী দখলদারি বাহিনীর অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে “ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত জুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।” সেদিন বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদান কালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয়। যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। একের পর এক পাকিস্তানী ঘাঁটির পতন হতে থাকে। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী উর্ধ্বতন অফিসাররা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিল পূর্বে চীন ও পশ্চিমে আমেরিকা থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে না।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি : যদিও জাতিসংঘ মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিল, কিন্তু তারা যুদ্ধ শুরু হবার আগেই রাজনৈতিকভাবে সমস্যাটি সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের বিষয়ে জাতিসংঘের এই অবহেলা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। তাছাড়া এ পরিস্থিতিতে বোঝা যায় জরুরি মুহূর্তে জাতিসংঘের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার অক্ষমতা। ৬ই ডিসেম্বরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। বেলা এগারোটার সময় “অল ইন্ডিয়া রেডিও” মারফত ঘোষণা করা হলো যে ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে বলা যায়, গোটা বিশ্ব এখন সচেতন যে তারা জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী অনেক সরকারই যেমনটা দাবি করতে পারবে না।”

আত্মসমর্পণ ও পরবর্তী ইতিহাস : গভর্নর হাউজে বোমা ফেলার কারণে গভর্নর মালেকের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের পদলেহী সরকারও ইতিমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত লিফলেট ফেলা হতে থাকে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ. এ. কে নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্খিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা বাংলাদেশে সকল পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করাতে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত হয়ে যায়।

শুরু হতে না হতেই শেষ : পাকিস্তান নিজ আদালতে বিচার করবেন এই প্রতিশ্রুতির কারনে শীর্ষ ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৩,০০০ সেনাসদস্যেকে ভারতের মাধ্যমে পাকিস্তানে ফেরত প্রদান করা হয়। তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কয়েক লক্ষ বাঙ্গালী আটক ছিল, সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – মূলত তাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই সমঝোতা। তবে বাংলাদেশের স্থানীয় যুদ্ধাপরাধী ও দালাল-দের বিচার বাংলাদেশ নিজেই করবেন – এটাই ছিল গৃহীত সিদ্ধান্ত। ১৯৭২-এ “দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশ” জারি করা হয়। পাশাপাশি ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই “আর্ন্তজাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন” প্রবর্তিত হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর আটক দালালদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে “যুদ্ধাপরাধ” এর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাদের সরকার সাধারণ ক্ষমা করেন তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনোটে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে – “ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজ-অগ্নিসংযোগের দায়ে দন্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রর্দশন প্রযোজ্য হইবে না”। অত:পর প্রায় ২৬,০০০ ব্যক্তি মুক্তিলাভ করলেও প্রায় ১১,০০০ ব্যক্তি আটক ও বিচারাধীন ছিল। ১৯৭৫ -এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাযক্রমই বন্ধ করে দেয়া হয়।

আন্দোলন : পরবতী সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়। ১৯৭৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নের্তৃত্বে, আশির দশকে ডা. এম এ হাসানের নের্তৃত্বে শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মঞ্চ হতে। তবে ১৯৯২ সালে “শহীদ জননী” জাহানারা ইমামের নের্তৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় এবং অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তাতে একাত্বতা ঘোষণা করেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন ক্যান্সারে জাহানারা ইমামের মৃত্যু হলে নের্তৃত্বে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। আন্দোলন শুধু পত্র-পত্রিকায়, গোলটেবিল বৈঠকে, আড্ডাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

রাজনৈতিক স্বার্থের বলি : মুক্তিযুদ্ধের নের্তৃত্বদান-কারী দল আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে অথচ রহস্যজনক ভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে নীরবতা পালন করে। দীর্ঘ ৫ বছরেও একজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হয়নি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, যার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা – যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত। শুধুমাত্র্র ভোটের রাজনীতির জন্য যুদ্ধাপরাধীর দল জামাতে ইসলামের সাথে তারা জোটবদ্ধ রাজনীতি করে এবং ঘৃণিত দুই যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রীসভায় স্থান করে দেয়। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নিকট হতে এই আচরণ অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশের ক্ষমতায় মাঝে ৯ বছর আসীন ছিলেন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার ব্যাপারেও আশা শূন্য, এই মর্মে প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে যে ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের “বিচার” এর জন্য পাকিস্তান কর্তৃক গঠিত ট্রাইব্যুনালের তিনি-ই ছিলেন প্রধান।

তিরিশ লক্ষের অধিক মানুষ হত্যার বিচার না হওয়ার বিষয়-টি শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষের জন্য অসীম লজ্জার!



তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া-র বাংলা ও ইংরেজী সংস্করনের একাধিক প্রবন্ধ।

সময়সীমা : তথ্যর সময়সীমা ২০০৬ পর্যন্ত।

জেনে রাখুন : যেহেতু বাঙলা কলেজে আন্দোলন ২০০৭ হতে শুরু তাই এই পৃষ্ঠার তথ্য ২০০৬ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। পরবর্তী সময়ের তথ্য “আন্দোলন” শীর্ষক পৃষ্ঠায় পাবেন। এই পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের ইতিহাস বা প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য নয় বরং শুধুমাত্র “১৯৭১ এর গণহত্যা”এবং “পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী-দের বিচার না হওয়া” এই দুটি বিষয়ের উপর কেন্দ্রীভূত।