বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি : ওয়ার ক্যাম্প, বন্দী নির্যাতন, নারীর সম্ভ্রমহানি, জবাই করা দেহ, পচা গলা লাশ, নরকংকাল, ৯ মাসের বিভীষিকা
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের নৃশংসতায় ৩০ লক্ষেরও বেশী মানুষ শহীদ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটাই সবচেয়ে বড় গণহত্যা !
বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ -এ আনুষ্ঠানিক বিজয় লাভ করলেও ঢাকার মিরপুর হানাদার মুক্ত হয় সবচেয়ে দেরিতে – ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ -এ। মিরপুর এলাকা বিহারী অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে হত্যাকান্ডের ব্যাপকতাও ছিল বেশী। মিরপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণক্ষেত্র। বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি শুধু মিরপুরেই নয়, বাংলাদেশর অন্যতম একটি বধ্যভূমি।
বাঙলা কলেজ একটি সুপরিচিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। আবুল কাশেম ১৯৬২ সালে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৬৮ সালে মিরপুরের বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৭১ -এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা বাঙলা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে অজস্র মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বর্তমান বিন্যাস অনুযায়ী, কলেজের অভ্যন্তরে বড় গেটের প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে ১৯৭১-এ পুকুর ছিল এবং হানাদার বাহিনী তার পাশে মুক্তিকামী মানুষ-কে লাইন ধরে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত। মূল প্রশাসনিক ভবনের অনেক কক্ষই ছিল নির্যাতন কক্ষ। হোস্টেলের পাশের নিচু জমিতে আটকদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হতো। অধ্যক্ষের বাসভবন সংলগ্ন বাগানে আম গাছের মোটা শিকড়ের গোঁড়ায় মাথা চেপে ধরে জবাই করা হতো, ফলে হত্যার পর এক পাশে গড়িয়ে পড়তো মাথাগুলো, অন্যপাশে পড়ে থাকত দেহগুলো। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই বাঙলা কলেজ ও আশেপাশে নৃশংস হত্যাকান্ড চলেছে, হয়েছে নারী নির্যাতন। কলেজের বর্তমান বিশালায়তন মাঠটি তখন ছিল ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। বিজয়ের মূহুর্তে তখন এই মাঠসহ পুরো এলাকা ও কলেজ জুড়ে পড়ে ছিল অজস্র জবাই করা দেহ, নরকংকাল, পচা গলা লাশ। বিভীষিকাময় গণহত্যার চিহ্ন ফুটে ছিল সর্বত্র।
রয়েছে প্রত্যক্ষর্দশী, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। ১৯৭২ এর জানুয়ারিতে দৈনিক পূর্বদেশ ও দৈনিক বাংলা পত্রিকায় এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির আরও তথ্য রয়েছে ডাঃ এম.এ. হাসানের “যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ”, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত “মুক্তিযুদ্ধ কোষ”, সুকুমার বিশ্বাস-এর “একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর”, মিরাজ মিজু-র “মিরপুরের ১০টি বধ্যভূমি” নামক গ্রন্থে। কলেজে ১৯৭১-এ কর্মরত কর্মী আনোয়ারা বেগম, মিরপুর এলাকার প্রথম চেয়ারম্যান ফকির শফিরউদ্দিন, মিরপুর মুক্ত করার অপারেশনে অংশ নেওয়া সেনাসদস্য ও গেরিলারাসহ বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই এই নৃশংসতা অবলোকন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী-র কাছেও এই সংক্রান্ত আরো তথ্য রয়ছে।
বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিতে শাহাদাৎ বরণকারীসহ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল শাহাদাৎ বরণকারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমরা তোমাদের ভুলব না…….