২০০৭ হতে ২০১০ পর্যন্ত সক্রিয় ছাত্র আন্দোলন

Movement demanding capital punishment for war criminals and preservation of memory of brutal genocide for Bangla College massacre


যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে এবং বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিতে নৃশংস গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন ...


বাঙলা কলেজে ১৯৭১-এ দিনের পর দিন গণহত্যা সংঘটিত হলেও কলেজ প্রশাসন বা সরকার স্বাধীনতার পর এত বছরেও স্মৃতিফলক নির্মাণের কোন উদ্যোগ নেয়নি। নূন্যতম একটি টিনের সাইনবোর্ড বা কলেজের প্রসপেক্টাসে এই যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি তুলে ধরা হয়নি। হয়তোবা অনেক বা শিক্ষার্থী বিষয়টি বিভিন্ন গ্রন্থের মাধ্যমে জেনেছিল কিন্তু কেউই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মত বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

বাঙলা কলেজের ৩ জন শিক্ষার্থী ৬ নভেম্বর ২০০৭-এ মিরপুর এলাকার অপর একটি বধ্যভূমি "জল্লাদখানা বধ্যভূমি" যেখানে স্মৃতিপীঠ নির্মিত হয়েছে – সেখানে প্রদর্শিত বধ্যভূমির নামের তালিকা হতে বাঙলা কলেজের গণহত্যার বিষয়টি জানতে পারে। একই সাথে বিস্মিত হয় এই ভেবে যে, কেন বাঙলা কলেজে নূন্যতম একটি স্মৃতিফলক নেই, যার মাধ্যমে বর্তমানসহ ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা বাঙলা কলেজে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে স্থায়ীভাবে জানতে পারবে। পরবর্তীতে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করলে সকলেই বাঙলা কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ হওয়া উচিৎ এই ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। এরই মাধ্যমে এই দাবীর সূত্রপাত ঘটে এবং আকস্মিকভাবে ইতিহাস থেকে মুছে গিয়ে প্রায় ভুলে যাওয়া একটি অধ্যায় সর্বসম্মুখে চলে আসে।


প্রত্যাশা

১২ নভেম্বর ২০০৭-এ কয়েকশ শিক্ষার্থী মিছিল করে অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানার দপ্তরে গিয়ে পদক্ষপে গ্রহণের জন্য চিঠি জমা দেয়। তবে অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানা মুক্তিযুদ্ধকে "ফালতু একটি চাপ্টার" বলে অভিহিত করেন ফলে ছাত্রছাত্রীদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং একপর্যায়ে শিক্ষার্থীবৃন্দ চিঠিটি টেবিলে রেখে – "রাজাকারের ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ চাই" – ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে মিছিল করে বের হয়ে এসে পুরো কলেজ প্রকম্পিত করে তোলে। তখন হতেই শুরূ হল আন্দোলন। আইন অনুযায়ী এত বড় মাপের প্রজেক্টের ক্ষেত্রে কলেজ প্রশাসনের কিছু করনীয় নেই তবে ছাত্রছাত্রীদের চিঠি সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে নৈতিক দায়িত্বটি পালন করতে পারতেন। এরপর ছাত্র-ছাত্রীরা সরাসরি সরকারের সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সরকারি বাঙলা কলেজ ১০০% রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ ও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনাধীন হওয়ায় কলেজ প্রশাসনের মতামত বা সুপারিশ এখানে সৌজন্য মাত্র কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। দন্ডমুন্ডের কর্তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছুর উদ্যোগ গ্রহণ, অর্থায়ন, ডিজাইন, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন করতে হবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘প্রস্তাব’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করবেন ও কলেজ প্রশাসনকে নির্দেশ প্রেরণ করবেন । ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজন সরকারের অনুমতি, অর্থ বরাদ্দ এবং জমি।


আন্দোলনের দাবি

যে আন্দোলনের সূচনা হল তার সুনির্দিষ্ট দুটো দাবি ছিলঃ

১) যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

২) বাঙলা কলেজে সংগঠিত গণহত্যার স্মরণে কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর নির্মাণ


গণ-সংযোগ

সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ও বাঙলা কলেজ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবিতে ব্যাপক জনমত তৈরীর জন্য গণসংযোগ শুরু করে। কলেজের সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ, সাবেক শিক্ষার্থীবৃন্দ, কলেজের বিশিষ্ট ছাত্র-নের্তৃবৃন্দ, অভিভাবক, মিরপুর এলাকাবাসী, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, বুদ্ধিজীবী মহল, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নের্তৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, নির্মূল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও প্রতিটি গণমাধ্যমকে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির ব্যাপারে অবহিত করা হয়। এ ছাড়াও ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রবাসীরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়। এই ব্যাপারে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে সচিত্র রিপোর্ট ও টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়।


আন্দোলনের কর্মসূচী

সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যোগে, নের্তৃত্বে ও সমন্বয়ে শুরু হওয়া চলমান এই আন্দোলনে কলেজের বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সংগঠন সুদৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে। ছাত্রলীগ সমর্থন দেয় ও সংহতি প্রকাশ করে। সক্রিয় ভাবে পাশে দাড়ায় ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্রদল নৈতিক সমর্থন দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির যেসকল কর্মী-সংগঠকবৃন্দ বাঙলা কলেজে অধ্যয়নরত – তাদের সকলের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যেরুপ ঐকমত্য হয়েছে, যদি জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সব দলের মধ্যে এরুপ ঐকমত্য হত তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বহু পূর্বেই নিষ্পন্ন হত।

বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ একাধিকবার র‌্যালি, মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, ২ মিনিট নিরবতা পালন, সমাবেশ, মিছিল, পথসভা, কালো কাপড়ের উপর ফুল অর্পণ ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালন করেছে।


ডিজিটাল আন্দোলন

আন্দোলন শুধু তৃণমূলেই নয়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্ব জনমতকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়াস নেয়া হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নির্মিত ওয়েবসাইট www.banglacollege.com এ ১৯৭১ এ গণহত্যার তথ্য, বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির স্যাটেলাইট ইমেজ ও তথ্য, ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের তথ্য, প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির ছবি, ফেসবুক অনলাইন কমিউনিটি রয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের স্ক্যানড ইমেজ, যেগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিই সংরক্ষিত রয়েছে।


অগ্রদূত

২০০৭ – এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যখন বিভিন্ন সংগঠন ও মহল নূতন করে ১৯৭১ -এর গণহত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারের বিচারের দাবি ঊত্থাপন করলো তখন বাংলাদেশের অন্য কোন স্কুল, কলেজ, নাগরিক বা রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই দাবিতে কোন কর্মসূচী গ্রহণ না করলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ও অনন্য উদাহরণ সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ। জরুরী অবস্থার মধ্যেও বাঙলা কলেজের সাধারন ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাধিক কর্মসূচী গ্রহণ করে বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি করলো।


নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া

শুধু ইতিবাচক নয়, কলেজের ভিতরে-বাইরে বিভিন্ন মহল হতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও পাওয়া গেছে! একটু পূর্বের হতে বিষয়টি তুলে ধরা যাক। অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানা এল.পি.আর.-এ গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর আনিস ফাতেমা কলেজের দায়িত্ব নেন। ঠিক এই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বধ্যভূমির উপরে ডকুমেন্টারী নির্মাণের জন্য কলেজে শুটিং ইউনিট পাঠান কিন্তু ভাইস প্রিন্সিপাল আনিস ফাতেমা অনুমতি না দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের অনুমতি নিয়ে আসতে বলেন যদিও তার কিছুদিন পূর্বেই "বিয়ার তাবিজ" নামে একটি নাটকের শুটিং হয়েছে সচিব মহোদয়ের অনুমতি ছাড়াই। প্রেমের নাটকের শুটিং করার অনুমোদন দেয় কলেজ প্রশাসন অথচ মুক্তিযুদ্ধে উপরে ডকুমেন্টারী নির্মাণের অনুমোদন নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের হতে। "এক দেশে দুই আইন" প্রবাদটির উৎকৃষ্ট উদাহরন বোধহয় এটি! (অবশ্য পরবর্তীতে নভেম্বর ২০০৮-এ ভাইস প্রিন্সিপাল আনিস ফাতেমা বদলী হয়ে গিয়েছেন ও নূতন একজন ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর বদরুন্নেসা এসেছেন, ইনার মনোভাব কিছুটা "ধরি মাছ না ছুই পানি" ধাঁচের।) জানুয়ারী ২০০৮-এ নুতন প্রিন্সিপাল ড. হামিদা বানুর আগমন ঘটলো। ৩১ জানুয়ারি ২০০৮ – "মিরপুর মুক্ত দিবস" -এ ছাত্রছাত্রীরা কলেজের ভিতরে অনুষ্ঠান করতে চাইলে প্রিন্সিপাল ড. হামিদা বানু অনুমতি দেননি ফলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে পুরো অনুষ্ঠানটি করতে হয় কলেজের সামনে ফুতপাতে। শুধুমাত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সম্মানের বিষয়টি বিবেচনা করে ছাত্রছাত্রীরা শক্তি প্রয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই দিন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, মুক্তিযোদ্ধারা কলেজে প্রবেশ করে কিলিং স্পটগুলো সরেজমিনে দেখার সামান্য এই অনুমতিও পাননি, যদিও তার কিছুদিন পর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে কলেজে এনে সংবর্ধনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কলেজ প্রশাসন। অবশ্য শিক্ষকদের একাংশ ও ছাত্রছাত্রীরা সেই প্রচেষ্টা বানচাল করে। এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেই মূহুর্তে কলেজের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা আলাপচারিতার সময় ছাত্র-ছাত্রীদের বলেন, "চাকুরীচ্যুতি ও পানিশমেন্ট ট্রান্সফারের ভয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির সাথে প্রকাশ্যে সম্পৃক্ত হ্ওয়া সম্ভব হচ্ছে না।"

বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির উপর রিপোর্ট করতে যেয়ে চ্যানেল আই-এর রিপোর্টার রহমান মুস্তাফিজ বিড়ম্বনার স্বীকার হন, একই ঘটনার সম্মুখীন হন দৈনিক সমকালের সাংবাদিক খায়রুল হোসেন রাজু। দৈনিক সংবাদে দীপংকর গৌতম বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির উপর কলাম লেখেন, এজন্য পত্রিকা অফিসে কে বা কারা ফোনে হুমকি দেয়।


নৈতিক বিজয়

পূর্বের বছর অর্থাৎ ২০০৮ এর ধারাবাহিকতায় ছাত্র-ছাত্রীরা ৩১ জানুয়ারি ২০০৯- এ সরকারি বাঙলা কলেজে "যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবিতে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের স্মরণে" কর্মসূচী গ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল শহীদের স্মরণে কাল কাপড়ের উপর ফুল অর্পণ, পথসভা, গণস্বাক্ষর, ভ্রাম্যমান জাদুঘর প্রদর্শনী। সবচেয়ে আকর্ষনীয় অংশ হল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ কিবরিয়া এবং ঢাকা ১৪ আসন হতে নির্বাচিত আওয়ামীলীগের এম.পি. আসলামুল হক উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে কালো কাপড়ের ফুল অর্পণ করেন। এরপর উপস্থিত সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্য সচিব বলেন অচিরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে এবং বাঙলা কলেজে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করে এই দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে, আগামী বছর আর কালো কাপড়ের উপর নয় বরং স্মৃতিসৌধের উপরেই ফুল দেয়া যাবে। মূলত সচিবের ফুল দেওয়ার মাধ্যমেই অবশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা সরকার মেনে নিল।

গতবার কলেজের সামনে ফুতপাতে এই কর্মসূচী পালিত হলেও এবার ২০০৯-এ কলেজ প্রশাসন নিজেই ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজের ভিতরে "যা খুশি করো" টাইপের ঢালাও অগ্রিম "অনুমতি" দেয়, এমনকি কলেজের দুজন শিক্ষক - ইংরেজী বিভাগের সেলিম মোল্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এ.কে.এম রিয়াজুল হাসান উপস্থিত হয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন। কর্মসূচীর দিন প্রিন্সিপাল ড. হামিদা বানু অসুস্থতার কারন দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকেন। ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসর বদরুন্নেসা কাল কাপড়ের উপরে ফুল না দিলেও বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সহধর্মিণী মিলি রহমানকে নিজ কে নিয়ে যেয়ে কলেজ প্রশাসনের অতীত কর্মকান্ডের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

২০১০ সালে নতুন প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. দিলারা হাফিজ সুদৃশ্য টেরাকোটার ফলকে বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির সংক্ষিপ্ত তথ্য কলেজের প্রশাসন ভবনের দেয়ালে সাটিয়ে দেন। পাশাপাশি সে বছর প্রকাশিত কলেজ ম্যাগাজিন "প্রদীপন" -এ শিক্ষিকা আফরোজ আরা বেগম রচিত সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের আরেকটি নৈতিক বিজয়।


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু, তবে তা অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন

১৩ জুলাই ২০১০ মঙ্গলবার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। একটা সরকারকে ক্ষমতায় আসার পূর্বেই সে কি কি করবে, তার "হোম ওয়ার্ক" সেরে রাখতে হয়। প্রথমত আইন প্রণয়ন ও গ্রেফতারের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতেই লম্বা সময় অতিবাহিত হয়। তারপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে তা কার্যকর শুরু হয়। গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িত যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা ১১,০০০ বিচার হয় মাত্র অল্প কয়েকজনের।


বাঙলা কলেজে পরিবর্তন

২০১৪ সালে কলেজের প্রিন্সিপাল মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর এস. এম. মকফুর হোসেন কলেজের প্রশাসনিক ভবনের যে কক্ষগুলো নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত হত, তার একটি স্মৃতি গ্যালারিতে পরিণত করেন - যা বংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ উদ্বোধন করেন। অবশ্য কলেজের প্রিন্সিপাল মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর এস. এম. মকফুর হোসেন চলে যাবার পর পরবর্তী প্রিন্সিপালদের কার্যভার-কালে বেশিরভাগ সময়ে স্মৃতি গ্যালারি তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকতো। যেহেতু একবার স্মৃতি গ্যালারি হয়েছে, তাই তা উঠিয়ে দেয়া সম্ভব না। কিন্তু দরজায় তালা মেরে রাখলে কেউ কোন দোষ ধরতে পারবে না। শুধু বিশিষ্ট কেউ আসলে খুলে দেখান হত।

২০১৯ সালে বাঙলা কলেজে নতুন প্রিন্সিপাল হয়ে আসেন প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খান। তার উদ্যমে বাঙলা কলেজের তিনটি কিলিং স্পটে তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় - যা বংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী ড. দীপু মনি, শিক্ষা বিষয়ক উপ-মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এবং লেখক-গবেষক ড. মুনতাসীর মামুন উদ্বোধন করেন।


সরকারের অভ্যন্তরে জামাতের এজেন্ট?

কলেজে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গ্যালারি অর্থাৎ জাদুঘর নির্মিত হয়েছে বাঙলা কলেজ প্রশাসনের উদ্যোগে। যেই তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে তার অর্ধেক বাজেট বাঙলা কলেজ প্রশাসন ও বাকি অর্ধেক সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রদান করেছে। ইন্টারেস্টিং অংশ হল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রজেক্টের সাথে জড়িত। তাহলে প্রশ্ন হল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাজটা কি? ১২ বছরের অধিক সময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা! এটা বিশ্বাসযোগ্য?

কলেজের জামাত পন্থী টিচাররাও সক্রিয় ছিল। কলেজে যে সকল স্পটে সাধারণত মুক্তিকামী মানুষকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হত, এরূপ ঠিক দুটো স্থানের উপরেই ভবন নির্মান করা হয়। আশেপাশে এত খালি জায়গা থাকতে বেছে বেছে ঠিক বধ্যভূমি স্পটের উপর ভবন নির্মাণের শখ হল কেন? উক্ত স্থান ইতিমধ্যে গণর্পূত অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত ছিল এবং এই স্থান নির্ধারনের পিছনে যৌক্তিকতা হচ্ছে: প্রথমত, এই অংশ কিলিং স্পটগুলো-র একটি। দ্বিতীয়ত, স্মৃস্তিস্তম্ভ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হলো ইতিহাস-টিকে ধরে রাখা ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে তা জানানো। যদি কলেজের ভিতরের দিকে এমন কোন স্থানে হয় যা সর্বসাধারণের দৃষ্টির আওতার বাইরে তবে মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। তৃতীয়ত, স্মৃতিস্তম্ভের ফ্রন্টে উম্মুক্ত মাঠ থাকলে সারা বছর ধরেই এই স্মৃস্তিস্তম্ভ পথসভা, নাটক, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদির জন্য মুক্তমঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারবে।

সরকার তালিকাভুক্ত এই বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি-তে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান - মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ‘১৭৬-টি বধ্যভূমি-তে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান প্রকল্প’র আওতায় করার সিদ্ধান্ত নিলেও দীর্ঘ কয়েক বছরেও আশানুরুপ অগ্রগতি হয় নি। যার কারণ ১৭৬-টি স্থানে বধ্যভূমি-র জমির দাগ নং, খতিয়ান নং, মৌজা নং ইত্যাদি তথ্য গণপূর্ত অধিদপ্তর এর মাধ্যমে পরিকল্পনা কমিশন হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পৌছায়নি। যদিও বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি-সহ অনেক বধ্যভূমি-র জমির দাগ নং, খতিয়ান নং, মৌজা নং ইত্যাদি তথ্য পৌছেছে। তারা যদি ১৭৬-টি স্থানে বধ্যভূমি-তে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করত অর্থাৎ বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি-সহ যেসব বধ্যভূমি-র জমির দাগ নং, খতিয়ান নং, মৌজা নং ইত্যাদি তথ্য পৌছেছে - তা প্রথম পর্যায়ে করে পরবর্তী বছরগুলোতে অন্যগুলি - তাহলে সমস্যা হত না। আমাদের বক্তব্য ছিল, "বাঙলা কলেজ বধ্যভূমি-সহ অন্যান্য বধ্যভূমি-র কাজ এই বছর হোক, পাশাপাশি বাকিগুলোর জন্য ফাইল প্রসেসিং চলুক।" অতঃপর সম্ভবত, প্রশাসনে জামাত সমর্থক গোষ্ঠী এভাবে পুরো বিষয়টা সাজানোর চেষ্টা করছেন যেন ১৭৬টি স্থানের কাজ একত্রে শুরু না করতে পারলে মারাত্মক কোন সর্বনাশ হয়ে যাবে! এভাবেই দেরি হয়।


৫০% সফল আন্দোলন

ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ছিল একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা, বড় আকৃতিতে। শেষ পর্যন্ত তিনটি হল, তবে তুলনামূলক ক্ষুদ্র আকৃতিতে। ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি ছিল কলেজের প্রধান ফটকের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর নির্মান করা। সেখান ১০ তলা ভবন নির্মিত হয়। জাদুঘরের বিষয়টা ছাত্র-ছাত্রীদের দাবির থেকেও সুন্দর হয়েছে, কারন নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত কক্ষকেই জাদুঘরে রূপান্তরের আইডিয়া আন্দোলনের সংগঠকদের কারো মাথায় আসে নি। তবে মূল কিলিং স্পটে ১০ তলা ভবন নির্মান হতাশাজনক। ভিন্ন কোন তিন তলা একাডেমিক ভবন ভেঙ্গে সেটাকে ২০ তলা করে সমস্যা সমাধান করে ফেলা যেত।

১১,০০০ যুদ্ধাপরাধীদের মধ্য অবশিষ্টগনের বিচার কবে নিষ্পন্ন হবে, তা কারোর জানা নেই।

তাই সামগ্রিক বিচারে আন্দোলনকে বলা যেতে পারে ৫০% সফল, ৫০% ব্যর্থ।




* তথ্য ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত আপডেটকৃত